সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ০২:১৮ পূর্বাহ্ন

চাঁদাবাজ নয়, ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়ের প্রেমিক ও তার তিন বন্ধুকে উদ্দেশ্য করেই গুলি ছোড়েন ঠিকাদার ইউসুফ!

এস.এম. সাঈদুর রহমান সোহেল, খুলনা ব্যুরো::

খুলনা মহানগরীর মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় ঠিকাদারের লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলিতে আহত স্কুলছাত্রী লামিয়ার (১৩) পায়ে অস্ত্রপচার সম্পন্ন হয়েছে।

সোমবার (৩১ আগষ্ট) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় দু’ঘন্টাব্যাপি অপারেশনের পর পা থেকে তার গুলিটি বের করা হয়।

এদিকে, ঠিকাদার শেখ ইউসুফ আলীর গুলি বর্ষণের ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। মূলত: মেয়ের প্রেমিক ও প্রেমিকের তিন বন্ধু বাড়িতে গেলে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের দিকেই গুলি করেন ঠিকাদার শেখ ইউসুফ আলী। ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েই স্কুলছাত্রী লামিয়ার বাম পায়ে বিদ্ধ হয়। ওই মামলায় মেয়ের প্রেমিকাসহ ৪ যুবককে পুলিশ গ্রেফতারের পরই এ তথ্য প্রকাশ পায়।

গুলিবিদ্ধ স্কুলছাত্রী লামিয়ার পায়ে অস্ত্রপচারের বিষয়টি নিশ্চিত করে খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মুন্সি রেজা সেকেন্দার বলেন, খুমেক’র উপাধ্যক্ষ ডাক্তার মেহেদী নেয়াজ ও ডা. অনুপ কুমার মজুমদারের তত্ত্বাবধানে তার পায়ে অস্ত্রপচার সফল হয়েছে। গুলিটিও বের করা হয়েছে।

এদিকে, ঠিকাদার ইউসুফের করা মামলায় গ্রেপ্তার চার যুবক হলেন, যশোরের কেশবপুর উপজেলার মো. মোস্তফা বিশ্বাসের ছেলে মোহাম্মদ আবু সাঈদ ওরফে শাহেদ (২২), বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার মল্লিক আব্দুল হাইয়ের ছেলে মো. ইসমাইল মল্লিক (২৭), খুলনার কয়রা উপজেলার শেখ হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. মেহেদী হাসান (২১) ও নগরীল দৌলতপুর থানার ৬নং ওয়ার্ডের মো. মিজানুর রহমান শেখের ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম (২৩)।

তবে ওই যুবকদের চাঁদাবাজ ও দুস্কৃতকারী হিসেবে উল্লেখ করে মামলাটি করেছিলেন ঠিকাদার ইউসুফ আলী। তার মামলায় অভিযোগ করা হয়, মিস্ত্রিপাড়া আরাফাত জামে মসজিদের পাশের বাবু খান রোডের সংস্কারের কাজ পেয়েছেন তিনি। কিছু দুষ্কৃতকারী এ কাজটির জন্য তাকে চাপ দিচ্ছিলেন। দুষ্কৃতকারীরা কাজটা কিনতে চান। শুক্রবার (২৮ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তারা চাঁদা চাইতে বাড়িতে গেলে লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তিনি গুলি ছোড়েন তিনি।

তিনি এজাহারে আরও উল্লেখ করেন, তার বাড়িতে গিয়ে ঠিকাদারি কাজের বদলে চার যুবক তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এক পর্যায়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিলে তিনি পিস্তল নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন। এ সময় পিস্তলে তিন রাউন্ড গুলি ছিল। তিনি দুই রাউন্ড গুলি ছোড়েন। ওই চার যুবকও দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করেছিল। তাদের ছোড়া গুলিই লামিয়ার পায়ে বিদ্ধ হয়েছে।

কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠিকাদার শেখ ইউসুফ আলীই গুলি করেন। বাড়িতে যাওয়া ওই যুবকদের কাছে কোনো অস্ত্রই ছিলো না। তারা কোনো চাঁদাবাজ বা দুস্কৃতকারী নন, তারা ঠিকাদারের মেয়ের প্রেমিক ও তার তিন বন্ধু। তাদের পরিচয় পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি দেন ঠিকাদার শেখ ইউসুফ আলী। পরিস্থিতি খারাপ হবে বুঝে বাড়ির লোকেরা তাদের বের হয়ে যেতে বলেন। তারা বের হতে না হতেই পিস্তল হাতে বেরিয়ে পড়েন ঠিকাদার ইউসুফ। তখনই তিনি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। আর শব্দ শুনে প্রতিবেশি স্কুল পড়ুয়া লামিয়া কৌতুহলবশত ঠিকাদারের বাড়ির সামনে যায়। ঠিক সেই সময় একটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিদ্ধ হয় শিশু লামিয়ার বাম পায়ে।

ঠিকাদারের করা মামলা ও তার দাবি করা সব তথ্য মিথ্যা বলে অভিযোগ করে ওই চার যুবকের স্বজনরা বলেন, ঠিকাদার ইউসুফ আলীর মেয়ে রুকাইয়া বানরগাতির সোহরাওয়ার্দী কলেজে পড়েন। ঠিকাদার তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মেয়ের মোবাইল ফোনও কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। রুকাইয়ার সঙ্গে শাহেদ নামে ছেলেটির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কয়েকদিন মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে প্রেমিক শাহেদ তার তিন বন্ধু মেহেদি, ইসমাইল ও সাইফুলকে নিয়ে যান ইউসুফ আলীর বাড়িতে। তারা রুকাইয়া ও শাহেদের দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্কের কথা বলতেই ইউসুফ আলী ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। তখন সেখানে উপস্থিত রুকাইয়ার মামা তাদের বের হয়ে যেতে বলেন। তারা বের হয়ে দরজা পর্যন্ত আসার পরে ইউসুফ পিস্তল নিয়ে বের হয়ে গুলি ছোড়েন। এ ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিতে ঠিকাদার মেয়ের প্রেমিক ও প্রেমিকের বন্ধুদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেছেন বলেও অভিযোগ স্বজনদের।

গ্রেফতার সাইফুল ইসলামের মামা মো. সোহেল বলেন, ‘আমার ভাগ্নে ও তার বন্ধুদের ওপর সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গুলি ছুড়েছেন ঠিকাদার ইউসুফ। আবার তাদের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির মামলাও করেছেন। আমরা বিষয়টি আইনিভাবেই মোকাবেলা করবো’।

ঠিকাদার ইউসুফ আলীর বাড়ির সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ওই চার যুবক স্বাভাবিকভাবে দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। তখন পিস্তল নিয়ে ছুটে আসেন ঠিকাদার ইউসুফ। মেয়ের মামা গুলি করতে বাধা দেন। কিন্তু তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ইউসুফ গুলি ছোড়েন এবং সিঁড়ি দিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করতে থাকেন। ঠিক তখনই ঠিকাদারের পিস্তলের ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লামিয়ার বাম পায়ে বিদ্ধ হয়।

এ বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার কানাই লাল সরকার জানান, ঠিকাদার ইউসুফ আলীর করা মামলায় ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে, আসল রহস্য উদঘাটনে ঘটনাটির আরও তদন্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার (২৮ আগষ্ট) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর মিস্ত্রি পাড়া আরাফাত মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় লক্ষভ্রষ্ট গুলিতে আহত হন ৬ষ্ট শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া। এ ঘটনায় পুলিশ স্থানীয় ঠিকাদার শেখ ইউসুফ আলীর একটি লাইসেন্সকৃত পিস্তল, অব্যবহৃত ১০ রাউন্ড গুলি ও দুই রাউন্ড গুলির খোসা জব্দ করে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com